অমৃত. দই খেতে খেতে ক্ষীরের কথা মনে পড়বে৷ ক্ষীর দই৷
১) অমৃত
দই খেতে খেতে ক্ষীরের কথা মনে পড়বে৷ ক্ষীর দই৷ একটাই সমস্যা, দুপুরে একটা সময় বন্ধ থাকে দীর্ঘক্ষণ৷ মিষ্টির দোকান মাঝে বন্ধ রাখা হয়েছে, এটা একমাত্র দেখেছি বালিগঞ্জ প্লেসের মুখার্জি সুইটসের৷ যেখানে অন্য রকম সরভাজা বা ভেজ-চপ বা মাংসের চপ খেতে প্রায়ই যেতে হয়৷
২) যাদব দাস
চিনি পাতা সাদা মিষ্টি দই খেতে চান? মনে হয় না, যাদবের কোনও বিকল্প রয়েছে৷ অসাধারণ খেতে৷ এমন সাদা মিষ্টি দই কলকাতায় বিরল৷ খুব বেশি মিষ্টি নয়, ধবধবে সাদা দই৷ শ্রীরামকৃষ্ণের কেন প্রিয় ছিল এখানকার মিষ্টি, তা বোঝা যায় দই দেখেই৷ উত্তরের ঝামাপুকুরের কেশব সেন স্ট্রিট, দক্ষিণের ট্র্যাঙ্গুলার পার্কে, দু’জায়গায় এই দোকান৷
৩) ভীম নাগ (বউবাজার)
মিষ্টি দই এদেরও সাদা৷ মিষ্টি একটু কম৷ তবে অন্য রকম খেতে৷ চামচ দিয়ে কেটে নিলে জল বেরোবে না৷ সমস্যা হল, লেডিকেনির আবিষ্কারকের দোকানে একশো গ্রামের ভাঁড়ে দই পাওয়া যায় না৷ কম করে আড়াইশোর ভাঁড় নিতে হবে৷ দাম অন্যদের থেকে বেশি৷ দুশো চল্লিশ টাকা কেজি৷
৪) কেসি দাস
মিষ্টি দইয়ের প্যাকেজিং সবচেয়ে ভালো৷ কাগজ দিয়ে ঢাকা৷ একশো গ্রাম প্লাস্টিকের কাপ৷ আড়াইশো গ্রাম হলে চমত্কার মাটির প্লেট৷ দইয়ের উপর রংটা অনেকটা হলদে৷ প্রথম দেখলে মনে হবে, আম দই বুঝি৷ আসলে উপরের সরের চাদর সরালে সাদাটে৷ একটু টক টক মিষ্টি দই পছন্দ করলে ভালো লাগবে এদের দই৷ দাম দুশো কুড়ি টাকা কেজি৷
৫) নিউ আশীর্বাদ সুইটস
বালিগঞ্জ স্টেশনের গায়ে এই দোকানে আম দইয়ের এক চমত্কার বিশেষত্ব রয়েছে৷ পুরো আম নিয়ে কাজ করা হয়৷ শুধু আমের পাল্প নয়৷ ফলে দইয়ের মধ্যে আমের আঁশ থেকে যায়৷ খাওয়ার সময় দইয়ে আঁশ পাবেন৷ একেবারে অন্য রকম লাগে৷ আম দইয়ের পাশে এখানে ভ্যানিলা বা স্ট্রবেরি দই খেয়ে দেখতে পারেন৷ অন্য রকম৷
৬) ভিআইপি সুইটস (চিংড়িহাটা)
একেবারে চাঁছির মতো দই৷ খাওয়ার সময় মনে হবে, দই খাচ্ছি না৷ অন্য কিছু খাচ্ছি৷ চাঁছি যেমন চামচে লেগে থাকে, এখানে মিষ্টি দইও তাই৷ তবে সব ভিআইপি সুইটসে এ জিনিস পাবেন না৷ ভিআইপি সুইটস এখন শরিকের মতো ভাগ হয়ে গিয়েছে গাঙ্গুরামের মতো৷ এক এক জায়গায় যেমন গাঙ্গুরামের ইন্দ্রাণীর এক এক রকম টেস্ট, ভিআইপির দইয়েরও তাই৷
৭) বলরাম-রাধারমন
বলরাম মল্লিকের কিছু মিষ্টির এত নাম, কিন্তু তাদের দইয়ের তেমন বিশেষত্ব নেই৷ সাধারণ৷ আম দই প্রথম হয়তো তারা গণহারে জনপ্রিয় করাতে শুরু করে৷ তাদের আম দইয়ের নীচে আমের পাল্প পড়ে থাকে৷ অন্য রকম খেতে৷ কিন্তু পারলে তাদের পয়োধি অবশ্যই খাবেন৷ দই এবং ক্ষীর মিশিয়ে এই অসামান্য পয়োধি৷ মনে হবে যেন পুরো ক্ষীর খাচ্ছি৷ মালদহে চাঁচলের কাছে কলিগ্রাম ক্ষীরের জন্য বিখ্যাত৷ চাঁছির মতো ক্ষীর৷ গোলা পাকিয়ে খাওয়া যায়৷ বলরামের পয়োধি অনেকটা ওই রকম৷ অবশ্যই খাবেন৷ এখন ওখানে ব্লু বেরির দই হচ্ছে৷ একটু অন্য রকম৷
৮) সেন মহাশয়
এখানকার দইয়েও ক্ষীর ক্ষীর একটা ব্যাপার রয়েছে অমৃতের মতো৷ ফড়েপুকুরে প্রধান দোকান৷ কিন্ত্ত শাখা অনেক৷ তবে একদিন গড়িয়াহাটের সেন মহাশয়ের এক বয়স্ক বিক্রেতাকে স্বীকার করতে শুনেছিলাম, অমৃতের মতো দই আমরা বানাতে পারব না৷
৯) মিঠাই
বেকবাগান বা তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি গড়িয়াহাটে মিষ্টি দই খুঁজলে প্লাস্টিকের কৌটোয় পাঁচশো-এক কেজির দই পাবেন৷ জেসি দাস বা ভীম নাগের মতো সাদা মিষ্টি দই৷ ভালো খেতে৷ একটু অন্য রকম৷
১০) সুরেশ সুইটস (ঢাকুরিয়া)
একেবারে টিপিক্যাল মিষ্টি দই৷ শীতকালে এদের পাতক্ষীর বা ছানার পায়েসের যা স্বাদ, তার তুলনায় দইয়ের অত নাম নেই৷ তবে ভালো খেতে৷ চেটেপুটে খেতে হবে৷ সুরেশের মিষ্টি বলরামের মতোই নানা রকম৷ ছোট দোকান৷ কিন্ত্ত কমলাভোগ থেকে রসমালাই-পরীক্ষানিরীক্ষা চমত্কার৷
১১) নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (গড়িয়া)
গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটা থেকে বাঘাযতীন-গাঙ্গুলিবাগান, অনেক বাড়িতে বিয়ে বাড়ি হলে সেখানে নারায়ণের দই আনাটা বাধ্যতামূলক৷ ওই অঞ্চলের অন্যতম সেরা৷
১২) গাঙ্গুরাম
তিন চারটে ভাগ হয়ে গিয়েছে দোকান৷ গাঙ্গুরামস, গাঙ্গুরাম অ্যান্ড সন্স, গাঙ্গুরাম অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স৷ এক এক জায়গায় এক এক রকম স্বাদ৷ এমনকী তাদের অসামান্য ট্রেডমার্ক ইন্দ্রাণী মিষ্টিও এক এক জায়গায় এক এক রকম৷ গাঙ্গুরামের দইও এক জায়গায় এক এক এক রকম৷ অনেক জায়গায় খুব সাধারণ৷ ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দ চাঁদনি চক স্টেশনের গায়ে গাঙ্গুরামের দোকানের লাল দই৷ চমত্কার স্বাদ৷
১৩) বাঞ্ছারাম
ভাঁড় দেখলে খেতে ইচ্ছে করবে৷ বিশেষত্ব হল, জমাট দইয়ের নীচে তরল ব্যাপার রয়েছে৷ চাপ চাপ দই ভালো লাগবে যাদের, তাদের এটা ভালো নাও লাগতে পারে৷ দুশো কুড়ি টাকা কেজি৷
১৪) সন্তোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
কলেজ স্ট্রিটে বহু পুরোনো দোকান৷ উত্তর কলকাতায় অনেক বাড়িতে বিয়েবাড়িতে সন্তোষের দই থাকা আভিজাত্যের প্রতীক৷ ক’দিন আগে গিয়ে দেখলাম, গোলাপি দইয়ে বিশেষত্ব কম৷ প্লাস্টিকের কাপে কেটে কেটে ১০০ গ্রাম করে দেওয়া হয়৷ দইয়ের সেই চাপ চাপ ব্যাপারটা থাকছে না৷ এই অঞ্চলে সবই দুশো টাকার কেজি দই হলেও এখানে এখনও ১৮০ টাকা কেজি৷ লাল দইয়ের পাশে ওই ভাবে কেটে বিক্রি হয় সাদা দই৷
১৫) পুঁটিরাম
সাদা দই৷ তবে একশো গ্রাম নিলে স্টিলের প্লেটে, স্টিলের চামচ দিয়ে দেওয়া হয়৷ জল কেটে বেরিয়ে যায়৷ যাদব বা ভীম নাগের সাদা দইয়ের কাছে পানশে৷
১৬) নবকৃষ্ণ গুঁই (বউবাজার)
লাল দই, তবে একটু বেশি টক টক ব্যাপার রয়েছে৷ তবে এখানেও বড় ভাঁড় থেকে কেটে কেটে দেওয়ায় চাপ ব্যাপারটা কম৷
১৭) মৌচাক
অনেক শরিকের ভাগ হয়ে গিয়েছে৷ ফলে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন জায়গায় টেস্ট৷ গোলপার্কের পুরোনো মৌচাক পাল্টে গিয়েছে৷ এদের দই খেতে গিয়ে হতাশ হতে হয়৷ তবে বেকবাগানে বিশ্বভারতীর গায়ে এদের মূল ও আদি দোকানে এখনও দই ভালো৷ তবে কলকাতার ভালো মিষ্টি দইয়ের মতো৷ বাড়তি বিশেষত্ব নেই৷
১৮) হিন্দুস্থান সুইটস
তুলসী থেকে গাজর-নানা রকম দই বানানোয় কলকাতায় সবচেয়ে আগে উদ্যোগ নেয় যাদবপুরের এই পরিচিত দোকান৷ সাধারণ মিষ্টি দই ভালো৷ কিন্ত্ত অন্য ভালো দোকানের মতোই৷ বাড়তি বিশেষত্ব কম৷
১৯) দ্বারিক ঘোষ
শরিকি ভাগের জের পড়েছে দোকানে৷ কিন্ত্ত দইয়ের স্বাদ অমলিন৷ সাদাটে মিষ্টি দইয়ে ক্ষীরের স্বাদ আছে অনেকটা৷ এদের সাদা টক দইও চমত্কার৷ শ্যামবাজার, এন্টালি, লালবাজারের মধ্যে কাদের দই ভালো বলা কঠিন৷
২০) কামধেনু
দক্ষিণ কলকাতায় বাঘাযতীন, সন্তোষপুর, গড়িয়ায় নবতম মিষ্টির ব্র্যান্ডের দিক দিয়ে পরিচিত৷ দই উপর থেকে একটু সাদাটে৷ ভিতরটা পুরোটা সাদা নয়৷ হালকা গোলাপি৷ ভালো, কিন্ত্ত বাড়তি কিছু নেই৷
২১) চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভান্ডার
শ্যামপুকুরের চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লা নিয়ে চার দিকে এত সুনাম, তুলনায় তাদের মিষ্টি দই নিয়ে এত চর্চা শোনা যায় না৷ তাদের মধুপর্কও অসামান্য৷ এর পাশে দই খেয়ে দেখতে পারেন৷ মনে হয়, রসগোল্লার মতো দইয়ের উপর নজর দিলে এদেরই সুনাম৷
২২) দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডার
বেহালার লোকেদের কাছে এর কোনও বিকল্প নেই৷ মিষ্টি দই একটু বেশি মিষ্টিই৷ তবে চেঁছেপুঁছে খেতে হবে৷
২৩) যশোদা মিষ্টান্ন (তালতলা) ও শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (সিঁথি) তালতলা অঞ্চলে যশোদার নাম সবাই এক ডাকে চেনে৷ এদের দোকানের দইও ভালো৷ এক একটা দোকানে দই এত গোলাপি হয় যে দেখলে মনে হয়, না জানি কী খাব৷ সিঁথির মোড়ে এই দোকানে ঢুকলে দইয়ের বড় বড় হাঁড়ি দেখা যায়৷ সে গুলো গোলাপিই বেশি৷ তবে খেতে বেশ ভালো৷
২৪) মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ
ল্যান্সডাউনে সাদার্ন এভিনিউ ক্লাবের কাছে অতি ভাঙাচোরা দোকানে সেরা খাবার ভেজিটেবল চপ এবং রসমু্ন্ডির পায়েস৷ এখানে ঢুকলেই উত্তরের বিখ্যাত তেলেভাজা চপের দোকান ‘নিরঞ্জন আগার’কে মনে পড়বে৷ এখানেও মিষ্টি দই একটু অন্য রকম৷ সাদাটে বেশি৷
২৫) মাদার ডেয়ারি
দিল্লির পটপরগঞ্জের প্রধান দফতর যে লাল দই আসে, তা দারুণ খেতে৷ এমনি কৌটো না দেখে খেলে ভাববেন, কলকাতার কোনও বড় দোকানের দই৷ কিন্ত্ত বাংলার মাদার দেয়ারির দই একেবারেই ভালো নয় এর তুলনায়৷ দিল্লির মিষ্টি দই ১০০তে ৮০ পেলে কলকাতার মাদার ডেয়ারিকে ২০র বেশি দেওয়া যাবে না৷ এখানে এক চামচ দই নিলেই জল বেরিয়ে যায়৷ চাপ চাপ ব্যাপারটা নেই৷ মসৃণতা নেই৷ স্বাদের বিচারে দিল্লির তুলনায় এটা অনেক পানসে৷ দিল্লির মাদার ডেয়ারির দই কলকাতার যে কোনও ভালো দোকানের দইয়ের সঙ্গে পাল্লা দেবে৷ ওই মাদার ডেয়ারির সাফল্যে এ ধরনের মিষ্টি দই বের করছে অনেক কোম্পানি৷ তবু মাদার ডেয়ারির কাছে পারছে না কিছুতেই৷
এত দইয়ের দোকান ঘুরে, সব খেয়ে টেস্ট করে লিখতে বসা যে কী মারাত্মক বিপদ, সবাই জানেন৷ সুগার যে কত বাড়ল, কে জানে! কিন্ত্ত একটা কথা পরিষ্কার করে লিখে রাখা ভালো- দই এবং মিষ্টিতে সেরা বলে কিছু হয় না৷ আমার কাছে যে সেরা, আপনার কাছে তা খুব খারাপ হয়ে যেতে পারে৷ অনেক ভালো মিষ্টি দইয়ের দোকান ছড়িয়ে রয়েছে শহরের কোণে কোণে৷ রাসবিহারীর মোড়ে মেট্রো স্টেশনের গায়ে বছর কয়েক আগে একটা দোকান ছিল ছোট্ট-লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার৷ দোকান বিক্রি হয়ে গিয়েছে কবে৷ তবে স্বাদ লেগে রয়েছে এখনও৷ এ ভাবেই আপনার নিজের পাড়ায় ছোট্ট মিষ্টি দোকানে যে দই পাবেন, তা অনেক ভালো ভালো দোকানে পাওয়া যাবে না৷ সেই সব মিষ্টি দোকানের কৃতিত্ব অনেক বেশি৷ আপনারা নিজেই এমন ছোট ছোট ভালো দইয়ের দোকানের খোঁজ দিতে পারেন, যা আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিল না৷ সেখানেই হয়তো পাওয়া যাবে সেরার সেরা মিষ্টি দইয়ের সন্ধান৷
দিন না, এমন কিছু অসাধারণ মিষ্টি দইয়ের দোকানের খোঁজ! আর একবার না হয় সুগারের ভয় উড়িয়ে বেরোন যাবে কলকাতার সেরা অমৃতের সন্ধানে! আরও এক বার এই এক বিষয় নিয়ে লিখতে বসব৷
Post a Comment