Header Ads

রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম (আঁটপুর) থেকে প্রকাশিত ২০১০-২০১১ বার্ষিক 'হোমাগ্নি' পত্রিকায় আমার অতিপ্রিয় ও আপনার জন শ্রী প্রদীপ রায়চৌধুরী মহাশয়ের কলম থেকে) II Ramakrishna sarada ashram Antpur

রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম (আঁটপুর)

রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম (আঁটপুর)

(রামকৃষ্ণ সারদা আশ্রম (আঁটপুর) থেকে প্রকাশিত ২০১০-২০১১ বার্ষিক 'হোমাগ্নি' পত্রিকায় আমার অতিপ্রিয় ও আপনার জন শ্রী প্রদীপ রায়চৌধুরী  মহাশয়ের কলম থেকে)

।।শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কৃপাপ্রবাহে স্নাত 'কলঙ্কিনী ত্রয়ী।।

                          (১ম পর্ব)

সৌন্দর্য নয়, আনন্দই হচ্ছে শিল্পের শেষ ফলশ্রুতি।
দুঃখের মতো অননভিপ্রেত আর কি আছে? ব্যর্থতার মতো শূন্যতাবোধ আর কি হতে পারে? কে-ই বা জীবনে দুঃখ, ব্যর্থতা,পরাভব চায়? কিন্তু শিল্পের জগতে আমরা তাই চাই। তাই পরম শোকাবহ কাব্য অথবা ট্রাজিক নাটক আমাদের চেতনাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। যা আমাদের সমগ্র সত্তাকে বিস্ময়রসে মন্থন করে, চেতনাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে এবং মনকে তামসিক জড়তা থেকে মুক্ত করে সাত্ত্বিক রসভোগে প্রস্তুত করে। তাই শোকাবহতাই নান্দনিক সৃষ্টির মূল উপাদান।
"মা আমাকে শুকনো সন্ন্যাসী করিসনি, আমায় রসে বসে রাখিস।" এই প্রার্থনাই করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ইষ্টদেবী, মা ভবতারণীর কাছে।শুষ্ক জ্ঞানচর্চা নয়, নির্বিকল্প ধ্যানসমাধিও নয়, তিনি চেয়েছেন রসের বশীভূত হতে। রস অর্থাৎ শিল্পসৃষ্টি থেকে যে সাত্ত্বিক আনন্দের জন্ম হয়, শ্রীঠাকুর তাই তাঁর ইষ্টদেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। মানুষের প্রতি আকর্ষণই তাঁকে ত্যাগী বৈরাগীতে পরিণত করতে পারেনি, বিশ্বের প্রতি অসীম ভালবাসাই শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনায় এক অনন্য মানব বোধ সঞ্চারিত করেছিল। জগত সৃষ্টিকে আমরা ঈশ্বরের লীলা বলি। কিন্তু যে প্রশ্ন মনের মধ্যে নড়েচড়ে ওঠে তাহলো ঈশ্বরের তো কোন অভাব বোধ নেই, তবে কেন তিনি বললেন, আমি বহু হব! কারণ বোধ হয় দুই না হলে খেলা জমে না,ভক্তেরা যাকে বলে লীলা। সৃষ্টিতত্ত্বের মূলে আছে একটি আনন্দবোধ। তেমন সৃষ্টি - সত্তার মূলেও আছে এমনই এক আনন্দসত্তা অর্থাৎ লীলা। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত জীবন ও সাধনা এমনই এক আনন্দময় বা নান্দনিক সত্তার দ্বারা বিধৃত।
এই নান্দনিক সত্তার তাগিদেই শ্রীরামকৃষ্ণ নরেন্দ্রনাথের গান শুনে সমাধিস্থ হতেন, বিনোদিনীর চৈতন্য চরিত্রের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতেন, কীর্তন পাঁচালীর দেহতত্ত্বমূলক ভক্তির গানের সঙ্গে বিভোর হয়ে নাচতেন, কাঠকয়লা দিয়ে উত্তরের বারান্দার দেওয়ালে ছবি আঁকতেন, গঙ্গার মাটি দিয়ে শিব দূর্গার মূর্তি গড়তেন মধুর কন্ঠে গান গেয়ে শ্রোতাকে পারমার্থিকভাবে আত্মহারা করে দিতেন, কী নারী, কী পুরুষ যে কোন ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করতে পারতেন।
 চিরন্তন সেই নান্দনিক সত্তার অন্বেষণে একদিন দেহসুখে আবদ্ধ পঙ্কিল জীবন ত্যাগ করে অচেনা অজানা এক পথের পথিক হয়ে হেঁটে ছিলেন তিনটি নারী। পথের শর্ত মেনে ছেড়েছিলেন দেহের অনুপম সৌন্দর্যের গর্ব, পান্না হিরে চুনি খচিত জড়োয়ার প্রলোভন, লাখ টাকার ঝাড়বাতিগুলি থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রোশনাই আর মদিরা মেদুর প্রহরে কলকাতার বাবুদের ছোঁড়া নজরানার হাতছানি। উথাল পাথাল করা জীবনের স্মৃতিগুলি কাকবিষ্টার মতো পরিত্যাগ করে যন্ত্রণা-অপমান, ললাঞ্ছনা-ঘৃণা আর সামাজিক বিষোদ্গার উপেক্ষা করে আলোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল তিনটি দুঃসাহসী পথযাত্রী।অবিরাম পথ চলে একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন এক আনন্দময় অচিন দেশে। তাঁদের জন্যই বোধহয় অপেক্ষারত ছিলেন সেই নান্দনিক সত্তা। ভুবনমোহিনী হাসি ছড়িয়ে প্রসারিত দুটি হাত বাড়িয়ে তাঁদের গ্রহন করেছিলেন সেই আনন্দময় লোকে।
কলঙ্কিনী ত্রয়ীর দুঃসাহসিক পদযাত্রা কাহিনী লিখবো বলেই এই রচনার অবতারণা। কারা এই ত্রয়ী - বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, আর মনিমালা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে পতিতা শ্রেনী থেকে সংগৃহীত বাংলা থিয়েটারের তিন অভিনেত্রী-শুচিবাগীশ সমাজপতিদের চোখে সামাজিক বিষবৃক্ষের বীজ।
 সেকালের থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সামাজিক মর্যাদার পরিমাপ করতে গিয়ে ফ্রান্সিস লেগেটকে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তির কথাই বারবার মনে পড়ে। স্বামীজী লিখেছিলেন যে," কলকাতার যে ফুটপাথে থিয়েটার, সেই ফুটপাথ দিয়ে চলতাম না পর্যন্ত।" তখন ভদ্রসমাজের চোখে থিয়েটার মানে নরক। শিক্ষিত ভদ্রসমাজ থিয়েটারের সঙ্গে শুধু সম্পর্ক ছেদই নয়, থিয়েটারের নাম পর্যন্ত ভদ্রসমাজে অচল হয়ে দাঁড়াল-আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও সমাজে অপাঙক্তেয় বলে ঘৃণিত হয়ে উঠলেন।
কিন্তু কেন এই বিদ্বেষ! কোন অপরাধে তদানিন্তন  ভদ্রসমাজ থিয়েটারকে আঁস্তকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন? শোনা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তই বেঙ্গল থিয়েটারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সাধারণ রঙ্গমঞ্চে নারীর ভূমিকায় অভিনেত্রীর ব্যবস্থা করতে কারণ তার আগে নারীর ভূমিকায় পুরুষরাই অভিনয় করতেন। ১৮৭৩সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর দুমাস পর ১৬ই আগষ্ট ১৮৭৩ তাঁর লেখা নাটক 'শর্মিষ্ঠা' অভিনীত হলো পতিতাশ্রনী থেকে সংগৃহীত দুই অভিনেত্রীকে নিয়ে। এই প্রথম দুটি নারী চরিত্রে আত্মপ্রকাশ করলেন দুই নারী। সারা সমাজ উদ্বেল হয়ে উঠল।
১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে "সাপ্তাহিক সংবাদ" স্থম্ভে 'সুলভ সমাচার' লিখলো,"যাত্রার পরিবর্তে নাটক অভিনীত হতে দেখিয়া আমরা মনে করয়াছিলাম, এতদিনের পর বিশুদ্ধ আমোদ লাভ করিবার ব্যবস্থা হইল। কিন্তু সে আশায় ছাই পড়িল। বেশ্যাদ্বারা অভিনীত হইলে নাট্য-মন্দির আর বিশুদ্ধ আমোদের স্থল রহিল না। যে কারণে খেমটার নাচ দেখা মন্দ কাজ সেই কারণেই বেশ্যার অভিনয় দেখা অত্যন্ত দোষের।
বেশ্যার অভিনয়ে দুটি দোষ। যে সকল পুরুষ বেশ্যার সাথে অভিনয় করেন তাঁদের চরিত্র ভাল রাখা কঠিন। দ্বিতীয়ত যাঁরা বেশ্যার অভিনয় দেখেন তাঁদেরও মন কলঙ্কিত হইবার সম্ভাবনা অধিক। সুতরাং বেশ্যার অভিনয় অবাধে প্রচলিত হইলে ভারতের আরো একটি সর্বনাশের দ্বার খোলা হইবে।.....শুনিলাম কতকগুলি সুশিক্ষিত লোক নাকি বেশ্যার অভিনয়ে উৎসাহ দিয়া থাকেন।যে সুশিক্ষার ফল বেশ্যার আমোদ, সে সুশিক্ষার মুখে আগুন। ভারতের অস্থিচর্মসার এ অবস্থায় নির্দয়রূপে ভারতমাতার মর্মে আর আঘাত করিও না, যথেষ্ট হইয়াছে। ভাই সকল, ক্ষান্ত হও,তোমাদের পায়ে পড়ি।দেশ ডোবে, আর কু-নীতি বিস্তার করিও না।"
বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও সরে গেলেন সাধারণ থিয়েটারের সংশ্রব থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, যিনি নারীর কল্যান কর্মে সারাজীবন উৎসর্গ করেছিলেন তিনিও থিয়েটারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন এই অপরাধের জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারও সাদারণ রঙ্গালয়ের স্পর্শ এড়িয়ে গেলেন। কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একবার প্রবোধ গুহকে বলেছিলেন, "তোমাদের অসুবিধা ওই মেয়েদের নিয়ে।" বাংলা থিয়েটারের সামাজিক মর্যাদা যে শুধু নটীকুলের জন্য ক্ষুন্ন হয়েছিল তাই নয়, নটীদের সংস্পর্শে থাকার দরুণ, বাংলার দু-জন শ্রেষ্ঠ মণীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ থিয়েটারের সঙ্গে তাঁদের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। অথচ, নটীরা না এলে বাংলা থিয়েটার মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারত না।
এই পটভূমিকায় ২১শে সেপ্টেম্বর, রবিবার, ১৮৮৪ সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ স্টার থিয়েটারে এলেন গিরীশ ঘোষের চৈতন্যলীলা নাটক দেখতে। কিন্তু তাঁকেও আসতে হল কিছু কিছু ভক্তের প্রবল আপত্তি অতিক্রম করে। রবিবার সকালে তাঁর ঘরে ভক্তদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হলো - বিকালে ঠাকুর নাকি যাবেন নরকের থিয়েটারে। কথা প্রসঙ্গে কেউ কেউ ঠাকুরকে বললেন, "ওখানে যাবেন না, ওখানে বেশ্যারা অভিনয় করে। চৈতন্যদেব, নিতাই এসব চরিত্রে অভিনয় করে তারা।"
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ভূবনভোলানো হাসি ছড়িয়ে বললেন : " আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব। তারা চৈতন্যদেব সেজেছে, তা হলোই বা। শোলার আতা দেখলে সত্যকারের আতার উদ্দীপন হয়।"
এক মহাবিপ্লবের ক্ষেত্র বোধ হয় প্রস্তুত হয়েই ছিল, শুধু অপেক্ষারত ছিল সেই মহাসংগ্রামী মহাপুরুষের মুখ নিঃসৃত বজ্রনির্ঘোষের মহালগ্নটির জন্য। তিনি শুধু অভিনয় দেখলেন না, বিষবৃক্ষের বীজ যে অভিনেত্রী সম্প্রদায় তাঁদেরই প্রতিনিধি চৈতন্যের ভূমিকা-অভিনেত্রী বিনোদিনীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে  বললেন, " এ মায়ের আর এক রূপ। " ভগবানের মুখ-নিঃসৃত এই নির্ঘোষ অভিনেতা অভিনেত্রীদের আত্মোপলব্ধিতে শুধু সহায়তাই করেনি, তাঁদের মনে যে আত্মমর্যাদা জাগিয়ে তুলেছিল তা ইতিহাসের পাতায় কখনো চোখে পড়েনি।
১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৮৪ স্টার থিয়েটারে "প্রহ্লাদচরিত্র"
নাটক দেখার পর গিরিশের আদেশে সমস্ত নটীরা ঠাকুরকে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করলেন এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ ঠাকুরের পাদস্পর্শ করে নমস্কার করলেন, ঠাকুর তখন কেবলই বলে চললেন, "মা থাক্ মা থাক্, থাক্ মা থাক্।" এ এক অপূর্ব লীলা নাটক - বাংলার ঘৃণিত, অবহেলিত নটনটীদের সঙ্গে গ্রহন করলেন বাংলার রঙ্গমঞ্চকে। তাঁর নান্দনিক সত্তার এক অনন্য প্রকাশ সেদিন সাধারণ মানুষের সামনে যে আদর্শটিকে তুলে ধরলো তা হলো বৃত্তি বা জীবিকা বাদ দিয়ে অভিনেত্রীদের শিল্পীরূপে প্রত্যক্ষ করা।
নাট্টকার অভিনেতা অমৃতলাল বসু সেদিনের স্মৃতি
রোমন্থন করে বলেছিলেন, " সেই প্রথমে  যখন দীনা অভিনেত্রী রঙ্গমঞ্চে শ্রীচৈতন্যের বেশে নদীয়ায় ঈশ্বরাবতারের লীলা অভিনয় করিয়াছে, তখন আমাদিগের হীন রঙ্গালয়কে বৈকুন্ঠে উন্নত করিয়া দক্ষিনেশ্বরে প্রকটিত ঈশ্বরের অন্য অবতার শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই অভিনয় বসিয়া দেখিয়াছেন, আমরা ধন্য হইয়াছি;দর্শক ধন্য হইয়াছেন ;বসুমতী ধন্য হইয়াছে।"
সেই দীনা অভিনেত্রীই বঙ্গরঙ্গমঞ্চের বিনোদিনী দাসী। বিনোদিনীই সর্বপ্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন-এমনকি গিরীশচন্দ্রেরও আগে। চৈতন্যলীলা ছাড়া আরো পাঁচটি নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় দেখেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেব।
'প্রহ্লাদ চরিত্রে' প্রহ্লাদ, 'বৃষকেতু'তে পদ্মাবতী, 'নিমাই সন্ন্যাসে' নিমাই, 'দক্ষযজ্ঞে' সতী রূপে এবং প্রহসনমূলক নাটক 'বিবাহবিভ্রাটে' বিলাসিনী কারফরমার ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে ঠাকুর মুগ্ধ হয়েছিলেন।
অক্ষয়কুমার সেন তাঁর শ্রীরামকৃষ্ণ-পুঁথিতে একদিনের একটি বিরল বিরল ঘটনার বর্ণনায় লিখেছেন -
একদিন মঞ্চমধ্যে প্রভুর গমন।
নিরখিয়া শ্রীগিরিশ পুলকিত মন।।
কি লম্পট, কি কপট, হীন হেয় জন।
বেশ্যা বারাঙ্গনা জাতি অভিনেত্রীগণ।।
আবাহন সকলেই বারে বারে করে।
পদরেণু ঠাকুরের শিরে ধরিবারে।।
অভিনেতা পুরুষেরা আসিয়া তথায়।
অভয় চরণরেণু ধরিল মাথায়।।
গিরিশের আশ্বাস বচনে পেয়ে বল।
উপনীত অবশেষে বারাঙ্গনা দল।।
গণনায় ষোলজনা যুবতী প্রখরা।
বসনে ভূষণে সজ্জা মুণিমনোহরা।।
দেখিয়া শ্রীপ্রভুদেব ভাবে ভরা চিত।
ধরিলা মোহন কন্ঠে শ্যামাগুণ গীত।।
মধুর প্রভুর স্বর পিকপাখী জিনি।
শ্রবনে মোহিত চিত যতেক রমণী।।
তারমধ্যে একজনা বিনোদিনী নাম।
মূর্ছিতা হইয়া পড়ে ধরায় অজ্ঞান।।
প্রসারিত ঠাকুরের শ্রীচরণ তলে।
দিব্যভাব সমুদিত অন্তর অঞ্চলে।।
গিরিশের কোন নাটকের নেপথ্যে এই বিরল ঘটনাটি ঘটেছিল তা বিনোদিনীর স্বরচিত " আমার কথা " নামক গ্রন্থেও পাওয়া যায়নি। পাঠক কেবল স্তম্ভিত হয়ে ভাবেন, একজন নারী উপলব্ধি ও অনুভূতির কোন পর্যায়ে পৌঁছালে শ্যামাসঙ্গীতের মূল ভাব হৃদয়ে ধারণ করে মূর্ছিতা হয়ে পড়েন!
শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণতি জানিয়ে আশীর্বাদ পাবার পর বিনোদিনী একদিন উপলব্ধি করেছিলেন মঞ্চের কাজ যা তিনি করেন, বস্তুতঃ তা পূজা। সাধিকা বিনোদিনীর এই বিচিত্র পূজার প্রেরণাদাতা ছিলেন দু-জন - গিরিশচন্দ্র ও শ্রীরামকৃষ্ণ।একজন ছিলেন তাঁর অভিনয় শিক্ষক আর অন্যজন প্রবহমান যুগের আধ্যাত্মিক দিশারী- যিনি বিনোদিনীর নিষ্ঠা ও আত্মহারা অভিনয়শৈলীর অনুমোদন ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
 তখন স্ত্রীলোক দর্শকদিগের মধ্যে কেহ কেহ এমন উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতেন যে আমার বুকের ভিতরে গুর্ গুর করিত। আবার আমার শচীমাতার হৃদয়ভেদী মর্ম-নিদারুণ শোকধ্বনি নিজের মনের উত্তেজনা, দর্শকবৃন্দের ব্যাগ্রতা আমায় এত অধীর করিত যে আমার দুই চক্ষের জলে নিজে আকুল হইয়া উঠিতাম। শেষে সন্ন্যাসী হইয়া সংকীর্তনকালে, "হরি মন মজায়ে লুকালে কোথায়, আমি ভবে একা দাও হে দেখা প্রাণসখা রাখ পায়।" গানটি গাহিবার সময়ের মনের ভাব আমি লিখিয়া জানাইতে পারিব না। আমার সত্যই মনে হইত যে আমি তো ভবে একা, কেহ তো আমার নেই। আমার প্রাণ যেন হরি পাদপদ্মে নিজের আশ্রয়স্থান খুঁজিত । উন্মত্তভাবে
সংকীর্তনে মূর্ছিতা হইয়া পড়িতাম। ....এই চৈতন্যলীলার অভিনয় নহে, আমার জীবনের মধ্যে "চৈতন্যলীলা " অভিনয়কালে আমার সকল অপেক্ষা শ্লাঘার বিষয় এই যে আমি পতিত পাবন পরমহংসদেব রামকৃষ্ণ মহাশয়ের দয়া পাইয়া ছিলাম। কেননা, সেই পরম পূজনীয় দেবতা 'চৈতন্যলীলা' অভিনয় দর্শন করিয়া আমায় তাঁর শ্রীপাদপদ্মে আশ্রয় দিয়াছিলেন। অভিনয় কার্য শেষ হইলে আমি শ্রীচরণ দর্শনের জন্য যখন অফিস ঘরে তাঁর চরণ সমীপে উপস্থিত হইতাম, তিনি প্রসন্নবদনে উঠিয়া নাচিতে নাচিতে বলিতেন " হরি গুরু গুরু হরি! বলো মা হরি গুরু গুরু হরি! " তাহার পর উভয় হস্ত আমার মস্তকে রাখিয়া আমার পাপদেহকে পবিত্র করিয়া আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন "মা, তোমার চৈতন্য হউক। "
গিরিশ শুধু বিনোদিনীর অভিনয় শিক্ষকই নন, আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও তিনি তাঁকে পুষ্ট করিতে সচেষ্ট ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ সকাশে এসে গিরিশ তখন সম্পূর্ন আমূল বদলে যাওয়া মানুষ। তিনি মুখে রামকৃষ্ণ বাণী ও নিজ উপলব্ধ সারবানীই উচ্চারণ করেছেন বিনোদিনীর সামনে। বিনোদিনীর শ্রীরামকৃষ্ণসকাশে পৌঁছবার মার্গটিও নির্মান করে দিয়েছিলেন ওই গিরিশচন্দ্রই। শ্রীরামকৃষ্ণ - বিনোদিনীর মধ্যে গিরিশই ছিলেন সেতুবন্ধ।
বাংলা! থিয়েটারের সুনাম যতই তদানীন্তন ভদ্রসমাজে প্রচারিত হতে লাগলো, গিরিশ ততই যত্ন সহকারে তাঁর প্রিয়তমা ছাত্রী বিনোদিনীকে নিজ তত্ত্বাবধানে গড়ে তুলতে লাগলেন।চৈতন্যলীলা নাটকের রিহার্সাল শুরু হলে অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শ্রী শিশির কুমার ঘোষ মাঝে মাঝে এসে শ্রীচৈতন্যের ভূমিকাভিনেত্রী বিনোদিনীকে উপদেশ দিতে লাগলেন। পতিতার দ্বারা অভিনীত সেই দেবচরিত্র যাতে যথাসম্ভব সুরুচি সম্পন্ন অভিনয়ের স্তরে উন্নীত হতে পারে তাই তিনি বারবার বলতেন ঃ"তুমি সতত গৌর পাদপদ্ম অন্তরে চিন্তা করবে। তিনি অধমতারণ পতিতপাবন, পতিতের উপর তাঁর অসীম দয়া।" তাঁর কথামত বিনোদিনীও সতত ভয়ে ভয়ে মহাপ্রভুর পাদপদ্মের চিন্তায় বিভোর হতেন। ১৮৮৪খ্রীস্টাব্দের ১লা আগস্ট মনের মধ্যে আকুল উদ্বেগ নিয়ে বিনোদিনী নিদ্রাহীন রাতের প্রহরগুলো গুনে চললেন। প্রহর হলো ; সুর্যের রাঙা আলোয় পূবের আকাশ উদ্ভাসিত। বিনোদিনী জানালার গরাদের মধ্য দিয়ে পূবের আকাশের দিকে চেয়ে প্রভাতের সূর্যকে প্রণাম জানালেন। তারপর তাঁর স্মৃতিকথা থেকেই বলি -
"প্রাতে উঠিয়া গঙ্গাস্নানে যাইলাম; পরে ১০৮ বার  দুর্গানাম লিখিয়া তাঁর চরণে ভিক্ষা করিলাম যে, মহাপ্রভু যেন এই সঙ্কটে আমায় কূল দেন।আমি যেন তাঁর কৃপা লাভ করিতে পারি । কিন্তু সারাদিন ভাবনায় অস্থির হইয়া রইলাম।........মনে মনে বুঝিতে পারিলাম যে ভগবান আমায় কৃপা করিতেছেন। কেননা সেই বাল্যলীলার সময় " রাধা বই আর নাইক আমার ; রাধা বলে বাজাই বাঁশী " বলিয়া গীত ধরিয়া যতই অগ্রসর হইতে লাগিলাম, ততই যেন একটা শক্তিময় আলোক আমার হৃদয়কে পূর্ণ করিয়া তুলিতে লাগিল। যখন মালিনীর নিকট হইতে মালা পরিয়া তাহাকে বলিতাম - 'কি দেখ মালিনী?' সেই সময় আমার চক্ষু বহির্দৃষ্টি হইতে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করিত। আমি তখন বাহিরের কিছুই দেখিতে পাইতাম না। আমি হৃদয়ের মধ্যে সেই অপরূপ গৌর পাদপদ্ম যেন দেখিতাম ;  আমার মনে হইত - 'ঐ যে গৌরহরি, ঐ যে গৌরাঙ্গ ' উনিই তো বলিতেছেন, আমি সব মন দিয়া শুনিতেছি ও তাঁহারই কথা মুখ দিয়া প্রতিধ্বনিত করিতেছি। আমার দেহ রোমাঞ্চিত হইত, সমস্ত শরীর পুলকে পূর্ণ হইয়া যাইত, চারিদিক যেন ধোঁয়ায় আছন্ন হইয়া যাইত। .....আমাতে আমি জ্ঞানই থাকত না। সন্ন্যাস গ্রহন করিয়া মাতা শচীদেবীর নিকট হইতে বিদায় লইবার সময় বলিতাম -
কৃষ্ণ বলে কাঁদ মা জননী
কেঁদ না নিমাই বলে।
কৃষ্ণ বলে কাঁদিলে সকলই পাবে
কাঁদিলে নিমাই বলে, নিমাই হারাবে
কৃষ্ণ নাহি পাবে-
ভূমিকা উপযোগী পরিচ্ছদে নিজেকে সাজিয়ে তোলার বিশেষ কৌশল বিনোদিনী পুরো মাত্রায় রপ্ত করেছিলেন। তাঁর এই বিশেষ পারদর্শিতার সাক্ষী হয়ে আছে দুটি মজার ঘটনা।
একদিন ভক্তচূড়ামণি বলরাম বসু ' বুদ্ধদেব চরিত ' নাটক দেখতে গেছেন। বিনোদিনী গোপার ভূমিকায় অভিনয় করছেন। তিনি প্রথম অঙ্ক দেখার পর হঠাৎ সাজঘরে ঘরে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। বলরামবাবুর ব্যাকুলতা দেখে গিরিশও হতচকিত। কনসার্টের সময় তিনি বলরামবাবুকে নিয়ে গ্রীনরুমে হাজির হলেন। বলরামবাবু এদিক  ওদিক দেখে কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইরে চলে এলেন।
গিরিশ বলরামবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, " সাজঘরে গেলেনই বা কেন, কি দেখলেন আবার তাড়াতাড়ি চলেই বা এলেন কেন!" বলরামবাবু মৃদু হেসে বললেন, " মঞ্চে গোপাকে দেখে ভাবলুম এই
অনবদ্য সুন্দরী নারীকে থিয়েটারওয়ালারা কোথা থেকে পেল? তাই তাকে দেখার জন্য মন অস্থির হয়েছিল। সাজঘরে গিয়ে দেখলাম যতটা সুন্দরী মঞ্চে লাগছিল ততটা সুন্দরী সে নয়। তবে বেশ সুন্দরী। " তারপর একদিন অসজ্জিত অবস্থায় বিনোদিনীকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে এই স্ত্রীলোকই সেদিন মঞ্চে গোপার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। বলরামবাবু বিনোদিনীর সাজসজ্জার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন।
সজ্জিত হতে শেখা অভিনয়ের একটা প্রধান অঙ্গ।
এ ব্যাপারে বিনোদিনী বিশেষ নিপুণা ছিলেন। বিনোদিনী ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় সাজসজ্জায় নিজেকে এমন পরিবর্তন করতে পারতেন যে, তাঁকে অপর এক ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেও, এই নতুন ভূমিকায় যে তিনিই এসেছেন তা দর্শক বুঝতে পারতেন না। বিনোদিনীর জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তে তাঁর পরিস্থিতি উপযোগী পরিচ্ছদে সুসজ্জিত হবার কৌশল একদিন সৃষ্টি করেছিল এক অনবদ্য ভক্ত - ভগবান লীলা - নাট্য। শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে বিনোদিনীর শেষ সাক্ষাতকার অত্যন্ত নাটকীয়। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন দুরারোগ্য গলরোগে আক্রান্ত হয়ে ৫৫নং শ্যামপুকুর স্ট্রীটের বাড়ীতে অবস্থান করছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করবার এই তীব্র ব্যাকুলতা থেকে বিনোদিনীর মানসিক পরিবর্তনের যে ছবি কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে মানুষকে হতচকিত করেছিল, তা পরবর্তিকালে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো গিরিশ ঘোষকে  লেখা তাঁর একটি চিঠি থেকে। চিঠিতে বিনোদিনী লিখেছিলেন - " সংসারের পান্থশালা হইতে বিদায় লইবার সময় নিকটবর্তি হইয়া আসিল। রুগ্ন, আশাশূণ্য দিনযামিনী একইভাবে যাইতেছে। আপনি আমাকে বারবার বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর বিনাকারণে জীবের সৃষ্টি করেন না, সকলেই ঈশ্বরের কার্য করিতে সংসারে আসে,সকলেই তাঁহার কার্য করে , আবার কার্য শেষ হইলেই দেহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়। আপনার এই কথাগুলি কতবার আলোচনা করিয়াছি, কিন্তু আমার জীবন দিয়া তো কিছু বুঝিতে পারলাম না, যে আমার দ্বারা ঈশ্বরের কি কার্য হইয়াছে, আমি কি কার্য করিয়াছি এবং কি করিতেছি? আজীবন যাহা করিলাম সেই কি আমার কার্য? কার্যের কি অবসান হইল না? "
শ্যামপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন করার আগ্রহ থেকে যেমন বিনোদিনীর মঞ্চ পরিত্যাগের পূর্ববর্তি মানসিক অবস্থার ছবিটি পরিষ্ফুট হয়ে উঠেছিল, গিরিশকে লেখা বিনোদিনীর চিঠি থেকে তেমনি তাঁর মঞ্চোত্তর জীবনের আগামবার্তা যেন ন ভেসে এলো। জীবনের গূঢ়-রহস্যকে জানার আগ্রহ , আত্মানুসন্ধানের এই প্রবৃত্তি কি শ্রীরামকৃষ্ণই তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিলেন? "বারবার আলোচনার" কথা বিনোদিনী লিখেছেন এবং গিরিশই সেই সময় তাঁর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবনার উপযুক্ত ব্যাখ্যাকার - তাই তাঁর কাছে বিনোদিনী এই গভীর প্রশ্নটি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
গিরিশ তাঁর উত্তরে বলেছিলেন, " তোমার জীবনে অনেক কার্য হইয়াছে, তুমি রঙ্গালয় হইতে শত শত ব্যক্তির হৃদয়ে আনন্দ প্রদান করিয়াছ। অভিনয়স্থলে তোমার অদ্ভূত শক্তির দ্বারা যেরূপ বহু নাটকের চরিত্র প্রস্ফুটিত করিয়াছ, তাহা সামান্য কার্য নহে। আমার ' চৈতন্যলীলা 'য় চৈতন্য সাজিয়া বহুলোকের হৃদয়ে ভক্তির উচ্ছ্বাস তুলিয়াছ ও অনেক বৈষ্ণবের আশীর্বাদ লাভ করিয়াছ। সামান্য ভাগ্যে কেহ এরূপ কার্যের অধিকারী হয় না। যে সকল চরিত্র অভিনয় করিয়া তুমি প্রস্ফুটিত করিয়াছিলে, সে সকল চরিত্র গভীর ধ্যান ব্যতীত উপলব্ধি করা যায় না। যদিও তাহার ফল অদ্যাবধি দেখিতে পাও নাই, সে তোমার দোষে নয়-অবস্থায় পড়িয়া; কিন্তু তোমার অনুতাপের দ্বারা প্রকাশ পাইতেছে যে অচিরেই তুমি সেই ফলের অধিকারী হইবে ।"
চিকিৎসার সুবিধার জন্য দক্ষিনেশ্বর কালী মন্দির থেকে ঠাকুরকে শ্যামপুকুরবাটীতে নিয়ে আসা হয়।
তাঁর ত্যাগী পার্ষদেরা বহিরাগত ভক্তসাধারণের বিশেষকরে বিশেষ করে স্ত্রীলোকেদের যাতায়াত নিষেধ করে দিয়েছেন। দর্শনব্যাকুল রূপসজ্জানিপুণ অভিনেত্রী বিনোদিনী একদিন সন্ধ্যায় কালীপদ ঘোষের ( দানাকালীর ) হাত ধরে পুরুষের মতো "হ্যাট কোটে" সজ্জিত হয়ে শ্যামপুকুর বাটীতে এসে উপস্থিত হলেন। ঠাকুরের পাহারায় থাকা ত্যাগী পার্ষদ প্রভৃতির কাছে দানাকালী বিনোদিনীকে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দিলেন। বিনোদিনীর দিকে চেয়ে কারুর সন্দেহ পর্যন্ত হলো না যে ইনি মহিলা এবং ভারতীয়। ঠাকুরের ঘরেও তখন কেউ নেই। দানাকালী ঠাকুরের ঘরে প্রবেশ করে বললেন, " ঠাকুুর আপনার শ্রীচরণ দর্শনের অভিপ্রায়েই বিনোদিনী বিদেশী ইউরোপীয় পুরুষের ছদ্মবেশে সবাইকে বিমূঢ় করে আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছে। "  রঙ্গপ্রিয় শ্রীরামকৃষ্ণ খিলখিল করে হাসতে লাগলেন। উপস্থিত সকল পার্ষদের চোখে ধূলো দিয়ে তাঁর কাছে এভাবে আসাতে তাঁর আনন্দের সীমা রইলো না। তিনি বিনোদিনীর সাহস, দক্ষতা, ও অপরিসীম শ্রদ্ধাভক্তি দেখে তারিফ করতে লাগলেন। প্রসন্ন বদনে বিনোদিনীর দিকে চেয়ে বললেন , " আয় মা বোস।" বিনোদিনীকে কাছে বসিয়ে তাঁকে ঈশ্বরীয় কথায় উদ্বুদ্ধ করে বললেন,
" ঈশ্বরে বিশ্বাসবতী হয়ে,  তাঁর শরণাপন্ন হয়ে জীবনের বাকী দিনগুলি কাটিয়ে দিও মা। ভয়মুক্ত হয়ে থাক। " বিনোদিনীও তাঁর শ্রীচরণে মাথা রেখে
আকূল অশ্রুবিসর্জনে নিজেকে সিক্ত করে তুললেন। ঠাকুরের অশেষ কৃপা মাথায় ধারণ করে
ধীর পদক্ষেপে কালীপদ ঘোষের সঙ্গে চলে গেলেন।
এই অভূতপূর্ব লীলাকাহিনী আজও বিমল আনন্দে মানুষকে আত্মহারা করে তোলে। ঠাকুরের ভাষায় একেই বোধহয় বলে ' ডাকাতে ভক্তি ' - যা কোন যুক্তি, তর্ক, বাধা-বিপত্তি কিছুই মানে না।
(শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাকে আশীর্বাদ করেছিলেন চৈতন্য-লাভের - চৈতন্যের আভাস তাঁর পরবর্তি চিন্তাধারার তরঙ্গমালায় বারবার প্রতিবিম্বিত হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগ ১৬ই আগষ্ট ১৮৮৬ এবং বিনোদিনীর মঞ্চ পরিত্যাগ ( বিনোদিনী শেষ অভিনয় করেন ২৫শে ডিসেম্বর ১৮৮৬) এক অদৃশ্য যোগসূত্রে কোথাও যেন বাঁধা পড়ে আছে। বিনোদিনীর মঞ্চোত্তর জীবনে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব যে কী গভীর রেখাপাত করেছিল তা অভিনেত্রী তারাসুন্দরীর কন্যা প্রভাতী খান্না তাঁর লেখনীতে বারবার রোমন্থন করেছেন। শ্রীমতী প্রভাতী খান্না বিনোদিনীর সাথে দীর্ঘদিন একসাথে বাস করেছেন।
তাঁর দৈনন্দিন জীবনের সকল দিকটাই তিনি জানতেন। তাই তাঁর ঘরোয়া জীবনের কথা, তাঁর
আধ্যাত্মিক জীবনের কথা বা তাঁর অভিনয়ে প্রীত শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদের কথা যেমনটি তিনি বিনোদিনীর মুখে শুনেছেন , তাই লিপীবদ্ধ করে গেছেন। প্রভাতী খান্না লিখেছেনঃ-  " বিনোদিনী নিজবাড়ীর তিনতলায় ঠাকুরঘর করেন। সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন রাধাকৃষ্ণ মূর্তি,গোপাল ও শালগ্রাম শিলা। রাধাকৃষ্ণের পূজা করতে আসতেন পুরোহিত। সেই ঠাকুরঘর ছাড়াও তাঁর নিজস্ব একটি ঘর ছিল-বিনোদিনীর নিজস্ব পূজাগৃহ। সেখানে ছিল শুধু শ্রীরামকৃষ্ণের পট। এখানে পূজা করতেন তিনি নিজে। গীতাপাঠ করতেন, আহ্নিক করতেন -শ্রীরামকৃষ্ণের পট পূজা করতেন ফুল চন্দনাদি দিয়ে।"
দীর্ঘ ৭৮বছর জীবিত ছিলেন বিনোদিনী। এই সুদীর্ঘ জীবনে বহু আঘাত এসেছে তাঁর জীবনে । যে মঞ্চের জন্য তিনি আত্মোৎসর্গ করেছিলেন সেই মঞ্চ তাঁকে পরিত্যাগ করে আসতে হয়েছে। যে সহৃদয় পরুষ তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যু হয়েছে, একমাত্র কন্যাটিকেও মৃত্যু তাঁর কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। চারিদিকে অসীম শূণ্যতার মাঝে শান্তির আশ্রয় খুঁজেছেন তাঁর কাছেই, যাঁর কাছে পেয়েছিলেন শান্তির আশ্বাস।
হরিনাম হলে স্বয়ং শ্রীহরি তা শুনতে আসেন, শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং তার প্রমাণ প্রদর্শন করলেন। তাঁর পদধূলিলাভে কেউই বঞ্চিত হননি। সকলেই পতিত কিন্তু পতিতপাবন যে পতিতকে কৃপা করেন, এ কথা শুধু পুরাণের পাতায় বদ্ধ হয়ে রইলো না - সত্যের আকার ধারণ করে পতিতমন্ডলীর হৃদয়ে পাঁচ সিকে পাঁচ আনা বিশ্বাসে রূপান্তরিত হলো।
বিনোদিনী অতি ধন্যা , শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন - " মা , তোর চৈতন্য হোক।" যাঁরা দুর্গম হিমালয়ের পর্বতকন্দরে যুগ যুগ ধরে কঠোর সাধনায় লিপ্ত হয়ে আছেন তাঁদের কাছেও এমন আশীর্বাদ স্বপ্নের অতীত। বিনোদিনীর সাধন - যথাজ্ঞান কায়মনোবাক্যে মহাপ্রভুর ধ্যানে নিযুক্ত থাকা। অষ্টপ্রহর গৌরাঙ্গমূর্তি ধ্যানের ফল বিনোদিনী লাভ করেছিলেন নিত্যানন্দের খোলে শ্রীচৈতন্যের পুনঃ আবির্ভাবে। অর্দ্ধ শতাব্দী পার হয়ে গেছে অনেক দিন তবু আধুনিক বিচারশীল মানুষের কাছে সাধিকা বিনোদিনী পারিপার্শ্বের নিরিখে উত্তরিত নারী। যতদিন শ্রীরামকৃষ্ণ নাম জগতে উচ্চারিত হবে, ততদিন বিনোদিনী উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের রূপ ধরে স্খলিত, পথভ্রষ্ট পথিকের যাত্রা পথের দিশারী হয়ে বিরাজ করবেন।
শেষ জীবনে দৈনিক সন্ধ্যায় আসতেন 'রামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠে'। শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ স্বামী অভেদানন্দের কাছে ধর্ম প্রসঙ্গ শুনতেন। কখনও কখনও শ্রীরামকৃষ্ণের মূর্তির সামনে বসে আকুল হয়ে কাঁদতেন অথবা ছুটে যেতেন বেলুড় মঠে যেখানে তাঁর আত্মারাম জীবন্ত জাগ্রত ও বিভাসিত হয়ে ভক্তের প্রতি তাঁর প্রেমদৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছেন।
বিনোদিনীই তারাসুন্দরীকে স্টার থিয়েটারে নিয়ে যান।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন,
" তারাসুন্দরীর আশ্চর্য প্রতিভা। ওর ওপরে একটা কবিতা রচনার ইচ্ছা আছে।"
কবি সত্যেন্দ্রনাথের সে ইচ্ছা পূর্ণ হলে বাঙলার নীতিবাগীশ সমাজপতিরা রঙ্গমঞ্চের এক পতিতা অভিনেত্রীর প্রতিভার যথার্থ স্বীকৃতি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতে পারতেন।
সেই তারাসুন্দরীকে একদিন বিনোদিনীই নিয়ে গেলেন বেলুড় মঠে। তারাসুন্দরী অপূর্ব ভঙ্গীমায় তাঁর সেই প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেনঃ
"যখন মঠে গেলাম, তখন প্রায় দুপুর উত্তীর্ণ হইয়াছে
- মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) সেবাঅন্তে বিশ্রাম করিতে যাইবেন-আমরা উভয়ে (বিনোদিনী ও তারাসুন্দরী) প্রণাম করিলাম। মহারাজ দেখিয়াই বলিলেন," এই যে বিনোদ, এই যে তারা- এসো এসো,এত বেলা করে এলে--মঠের খাওয়া দাওয়া যে সব হয়ে গেছে - আগে একটু খবর দিতে হয় -তাইতো বসো বসো।" দেখলাম আমাদের জন্য বড়ই ব্যস্ত। তাঁহার আদেশে তখনই প্রসাদ আসিল। লুচি ভাজাইবার ব্যবস্থা হইল। আমরা ঠাকুর প্রণাম করিয়া মঠে প্রসাদ পাইলাম। মহারাজের তখন আর বিশ্রাম করা হইল না। একটি সাধুকে ডাকাইয়া বলিলেন- " এদের সব মঠের কোথায় কি আছে দেখিয়ে দাও।" পরে পরিচয় হইলে জানিলাম-সাধুটির নাম স্বামী অমৃতানন্দ।
সাধু সন্ন্যাসীকে ছোটবেলা হইতেই ভক্তিশ্রদ্ধা করতাম কিন্তু তার সাথে সাথে ভয়টাও ছিল খুবট বেশী। অপবিত্রা-পতিতা কি জানি যদি কোন অপরাধ হয়, তাই আমি প্রথমে ভয়ে সঙ্কোচে মহারাজের চরণধূলি লইয়াছিলাম। কিন্তু মহারাজের (স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর) কথায় আমাদের জন্য ব্যস্ততায় ,তাঁর যত্নে, সে ভয় সঙ্কোচ কোথায় উঠিয়া গেল। মহারাজ বলিলেন "আস না কেন?" আমি বলিলাম "ভয়ে মঠে আসতে পারি না।" অতি আগ্রহের সহিত মহারাজ বলিলেন , " ভয়ে!ঠাকুরের কাছে আসবে তার আবার ভয় কী? আমরা সকলেই ঠাকুরের ছেলে-মেয়ে ভয় কি! যখন ইচ্ছা হবে এসো। মা,তিনি তো খোলটা দেখেন না ভেতরটা দেখেন। তাঁর কাছে আসতে তো কোন সঙ্কোচ নেই।"
স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, " ঠাকুরের কাছে আসতে কারুর তো কোন বাধা নেই।"
বৈকালে চা খাইয়া মঠ হইতে ফিরিলাম। আসিবার সময় মহারাজ বলিলেন " মাঝে মাঝে এসো। আজ বড় কষ্ট হলো। একদিন ভালো করে প্রসাদ পেও।"
এই আমার প্রথম দর্শন - এই আমার প্রথম বন্ধন।"
এই সুদৃঢ় বন্ধনই তারাসুন্দরীকে বারবার বেলুড় মঠের অঙ্গনে এনে দাঁড় করিয়েছে। কলকাতায় সেবার ভীষণ গরম পড়েছে। প্রখর রৌদ্রের মধ্যে তারাসুন্দরী ছুটে চলেছেন আত্মারামের আকর্ষণে-ঘর্মাক্ত,পথশ্রান্ত।সোজা উঠে এসেছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে। মহারাজ নিজে হাত পাখা নিয়ে হাওয়া খেতে খেতে তারাসুন্দরীকেও হাওয়া করতে লাগলেন। ' তারা-মা তুমি বড্ড ঘামছো !' তারাসুন্দরী কুন্ঠায় সঙ্কুচিত। তারাসুন্দরী অবাক হয়ে চিন্তার গভীরে প্রবেশ করলেন - একেই কি বলে জমাট বাঁধা প্রেম - প্রেমের শরীর! এ প্রেম তারাসুন্দরী কোনদিন অনুভব করেননি। আবেগ মথিত অন্তস্থল থেকে উপচে পড়া অশ্রুধারায় চোখদুটি ঝাপসা হয়ে গেছে। মাথা নীচু করে নিজেকে কেবলই সামলাবার চেষ্টা করছেন তারাসুন্দরী।
স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছেই দীক্ষালাভ করেন তারাসুন্দরী। যখন ভুবনেশ্বরে ধর্মতলায় ছিলেন, সেই সময় নবগঠিত ভুবনেশ্বর মঠে স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে প্রতিদিন যেতেন। তারাসুন্দরীর কন্যা প্রভাতী খান্না ভুবনেশ্বর মঠের স্মৃতি রোমন্থন করে লিখেছেন -
"সেই সময় মা মহারাজের (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কাছে বহু তত্থকথা শ্রবন করতেন ও নানা অলৌকিক অনুভূতি ও দর্শনাদি লাভ করেন এবং জীবনের লক্ষ্যস্থলের সন্ধান পান। ত্যাগমার্গকেই বাছিয়া লইলেন। শুনিয়াছি মার তখন ৩৩বছর বয়স। তখন হইতেই মা সংসারে থাকিয়া অনাসক্ত জীবন যাপন করিতেন। মোটা গড়া- কাপড় পরিতেন। ভূমিতে শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই কম্বল শয্যা, একবেলা এক মুষ্টি আতপ চাল দুধের মধ্যে সিদ্ধ করিয়া একবার মাত্র আহার করিতেন,রাত্রে কোনদিন মুড়ি-মুড়কী অথবা অল্প একটু মিষ্টান্ন অথবা শুধুই একগ্লাস জল খাইয়া রাত্রের আহার সম্পন্ন করিতেন।"
Powered by Blogger.