Header Ads

কে এই আমি? ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মানুষের পক্ষে এই বিরাট পাকা-আমিরুপী স্বামী বিবেকানন্দকে বোঝা অসম্ভব।

*বহুরূপে বিবেকানন্দ*

*---স্বামী চেতনানন্দ*
          
        [১]

   *'আমি অশরীরী বানী'*

*'আমি অশরীরী বানী'* কথাটি আনকোরা নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ। কে এই আমি ? কেনই বা তিনি অশরীরী ? আর কী-ই বা তাঁর বাণী? এই ত্রিবিধ প্রশ্নের উত্তর আমরা স্বামী বিবেকানন্দের মহান জীবননাটকের আলোকপাতে দেখতে চেষ্টা করব।
Swami Vivekananda
Swami Vivekananda
প্রাচীনকালে বৈদিক ঋষিদের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল কতকগুলি আপ্তবাক্য : যেমন ঋগ্বেদে-- *'প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম'* (ঐঃ উপঃ) , যজুর্বেদে -- *'অহং ব্রহ্মাম্মি'* (বৃঃ উপঃ) ,  সামবেদে -- *'তত্ত্বমসি'*  (ছাঃ উপঃ ) এবং অথর্ববেদে -- *'অয়মাত্মা ব্রহ্ম'* (মাঃ উপঃ )।
বহুযুগ পরে ঊনবিংশ শতকের নরঋষি স্বামী বিবেকানন্দের মুখে আমরা শুনলাম,  বৈদিক ধাঁচের মহাবাক্য : *'আমি অশরীরী বাণী,'*  *'আমি জগতের নৈব্যক্তিক সত্তা।'*
কে এই আমি?   ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মানুষের পক্ষে এই বিরাট পাকা-আমিরুপী স্বামী বিবেকানন্দকে বোঝা অসম্ভব। তাঁর  সমস্ত জীবন ছিল ইন্দ্রিয়াতীত দিব্য অনুভুতির দ্বারা ভরপুর ,  আর তার বাণী আত্মার মর্মবাণী। তাই স্বামী বিবেকানন্দের 'আমি'কে বুঝতে গেলে হয় আমাদের এই বিষয়াসক্ত মনকে কমপক্ষে কয়েক ধাপ উপরে টেনে তুলতে হবে নতুবা কোনও অনুভুতিবান পুরুষের মুখ থেকে জেনে নিতে হবে কে এই আলোকসামান্য মহাপুরুষ।
প্রথমে আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ থেকে শুনব কে এই নরেন্দ্রনাথ?  শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর এই প্রিয় শিষ্য সম্বন্ধে বলতেন : *'নরেন্দ্র ধ্যানসিদ্ধ, মহাপুরুষ। নরেন্দ্রের খুব উঁচু ঘর--নিরাকারের ঘর। পুরুষের সত্তা।'*
কখনও বলতেন, *'নররূপী নারায়ণ, জগৎ-কল্যানের জন্য ধরাধামে অবতীর্ণ '* জহুরী জহর  চেনে।  একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণই ঠিক ঠিক চিনেছিলেন স্বামীজীকে।  তাই আমরা দেখি ,  পরবর্তীকালে স্বামীজীর ভিতর তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি উৎসারিত করে দিয়ে বলেছিলেন,  *'আজ যথাসর্বস্ব তোকে দিয়ে ফকির হলুম! তুই এই শক্তিতে জগতের অনেক কাজ করবি।'*
নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁর রসঘন নাটকীয়ভঙ্গীতে  স্বামীজীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন -- _'নরেনকে বাঁধতে গিয়ে স্বয়ং মহামায়া বড় বিপদে পড়েছেন। তিনি যত নরেনকে বাঁধতে যান ,  সে তত বড় হয়ে যায়,  ফলে মহামায়ার দড়ি আর কুলায় না।'_
আর একটি ছোট সুন্দর ঘটনার অবতারণা করছি। বেলুড় মঠ তখন সবে প্রস্তুত হয়েছে। সাধু নাগমহাশয় স্বামীজীর সঙ্গে মঠে দেখা করতে এসেছেন। স্বামীজীকে দেখে সেই অনুভূতিবান আদর্শগৃহীর কী সুন্দর অভিব্যক্তি : *'আপনাকে দর্শন করতে এলাম। জয় শংকর! জয় শংকর!  সাক্ষাৎ শিবদর্শন হলো।'* এই সেই বাল্যের বীরেশ্বর  (বিলে)  আর পরবর্তীকালে বিরাট 'আমি 'রূপী বিবেকানন্দের স্বরূপ।
স্বামীজীর গুরুভাইরা স্বামীজীকে দেখতেন তাঁদের প্রিয়তম গুরুর প্রতিনিধিরূপে।  পূজ্যপাদ হরি মহারাজ  (স্বামী তুরীয়ানন্দ) একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন ,  *"স্বামীজী একবার আমাদের বললেন,তোমরা আগে আমাকে বোঝ, তারপর তাঁকে  (ঠাকুরকে) বোঝার চেষ্টা করবে।'  দেখ ,  স্বামীজী আর কিছু না হলেও একজন সম্পূর্ণ মানব (Perfect Man)। এইরূপ সম্পূর্ণ মানবের ধারণাই যদি না করা যায় তবে ভগবানের ধারণা করা কি সম্ভব?"*
হিমালয়ে প্রব্রজ্যাকালে একজন মুসলমান স্বামীজীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেছিলেন, _'স্বামীজী,  যদি ভবিষ্যতে কেহ আপনাকে অবতার বলে দাবী করেন ,  স্মরণ রাখবেন যে ,  আমি মুসলমান হয়েও সকলের মধ্যে অগ্রণী।'_  পাশ্চাত্যের বহু মনীষীও স্বামীজীর আমিকে বুঝতে গিয়ে বলেছেন,  ইনি কোনও বিরাট সত্তার অবতার--হয়তো বুদ্ধের -- হয়তো খ্রীস্টের!'
সূর্য যেমন স্বয়ংপ্রকাশ ,  সেইরূপ আত্মজ্ঞানী ব্যাক্তিই  নিজের স্বরূপ প্রকৃষ্টরূপে উপলব্ধি করে থাকেন। স্বামীজী জানতেন তিনি কে।  এমনকি তাঁর পূর্বজন্মের বিষয়ে অবগত ছিলেন।  আমেরিকায় একদিন 'পুনজন্মবাদ' -এর উপর বক্তৃতার পর প্রশ্নত্তরে বলেছিলেন, *'আমি বাল্যাবধিই আমার পূর্বজন্মের বিষয়ে অবগত আছি।'* আমেরিকায় আর এক বক্তৃতায় অনুভুতির  চরমতত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে স্বামীজী বুকে হাত দিয়ে সজোরে বলেছিলেন ,  *"I am God"।*  এই বক্তৃতায় অনেকে বুঝেছিলেন যে স্বামীজী কী এক গুরুতর কথা বলে ফেলেছেন।  স্বামীজী ধরা পড়েছেন তাঁর নিজের কথায়।  কতবারই না তিনি বলেছেন : *'বুদ্ধ খ্রীস্টের ন্যায় আমিও সেই অনন্ত সোহহং  (ব্রহ্ম ) সমুদ্রের তরঙ্গ মাত্র।'* জীবনের শেষপ্রান্তে ক্যালিফোর্নিয়াতে এক পাশ্চাত্য নারীকে স্বামীজী বলেন ,  *'আমার মৃত্যুর ১০ বছরের মধ্যে আমি ভগবানরূপে পূজিত হব।'*
স্বামীজীর এইসব স্বকথিত আত্মপরিচয়ে গোঁড়া ব্যাক্তি মনে করবেন,  এই বুঝি বিধর্মীসূচক বাক্য ,  অল্পবুদ্ধ ব্যাক্তি হয়তো মনে করবেন,  এ বুঝি দাম্ভোক্তি।
এ প্রশ্নের উত্তর বহু বছর আগে মনীষী ব্যাক্তি তাঁর আটপৌরে ভাষায় দিয়ে গিয়েছেন : " বিবেকানন্দের কর্মে ও চিন্তায় যদি কিছু আধ্যাত্মিকতা থাকে ,  তবে তা এই 'অহংকারের' মধ্যে ঢুঁড়তে হবে। অহংকারের এই দম্ভলে যে জীবনে নাই ,  সেই জীবনে বিবেকানন্দের প্রবেশ নাই। অহংকারের এই দম্ভলে --যে জীবন চাঙ্গা হয়েছে,  সেই জীবনেই বিবেকানন্দের লীলাক্ষত্র। লোকে বলবে,  'আরে ভায়া,  এই ব্যাক্তিত্বনিষ্ঠা,  এই পুরুষকার , এই পৌরুষপ্রতিষ্ঠা,  এই আত্মগৌরব ,  এই আত্মচৈতন্য ,  এই আত্মকর্তৃত্ব,  এই অহংকার --এই সবই যে বেদান্ত। ' বিবেকানন্দ উত্তর দিবেন না, : *"আরে বেদান্ত আর আমি কি আলাদা?"*
শরীর যাওয়ার আগে বেলুড় মঠে স্বামীজী বলেছিলেন  ,  *'আর একটা বিবেকানন্দ থাকলে বুঝত এ বিবেকানন্দ কি করে গেল।'* তাই স্বামীজীর 'আমি'কে সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কত বড় অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আমরা এই মহাজীবনের উপর শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন করব , কারণ পরশমণি স্পর্শে আমরা সোনা হব।
Powered by Blogger.